Sunday, May 11, 2014

আসুন স্বাধীন/মুক্ত পেশাজীবি হই, নিজের ও দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করি

আসলে স্বাধীন পেশা হচ্ছে সেই পেশা যেখানে আপনি নিজেই উদ্যোক্তা। আপনার নিজের উদ্যমের উপর নির্ভর করবে আপনার পরিচিতি, আয়, সম্মান সবকিছু। যেমন: ব্যবসা, অনলাইন আউটসোর্স ফ্রীল্যান্সারদের পেশা, কনসালট্যান্টদের স্বাধীন পেশা, আইন পেশায় যারা আছেন তাদের স্বাধীন পেশা, ডাক্তার যারা নিজেরা প্র্যাকটিস করেন তাদেরও স্বাধীন পেশা। যে কোনো মানুষের মেধার সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হয় স্বাধীন পেশায়। প্রচার-প্রসার-প্রাচুর্যও অর্জন হয় এতে। কিন্তু সাধারণ কিছু ভ্রান্ত ধারণার ফলে স্বাধীন পেশার স্বাধীনতায় আমরা ঘাবড়ে যাই সহজেই। যেরকম:
§                                 কেরানিগিরিতে অভ্যস্ত বাঙালির পক্ষে কি স্বাধীন পেশা সম্ভব?
§                                 চাকরি হলো সম্মানজনক পেশা। আর ব্যবসা অসম্মানের
§                                 সৎভাবে ব্যবসা করা যায় না। লাভ করতে হলে অসৎ হতে হয়
§                                 ফ্রীল্যান্স আবার কোন পেশা হলো! ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুব সমাজ বিপথে যায়, এটা আয়ের কোন কাজে আসে না
§                                 ঘরে বসে আয় করা সম্ভব নয়
আমাদের এই ভ্রান্ত ধারণা গুলোর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তবেই আমরা নিজের দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারবো

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রধানত তিনটি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন-ব্যবসা, শিল্প এবং কৃষি। কৃষিতে তাদের মেধা এত বিকশিত হয়েছিলো যে ৪০০ প্রজাতির ধান উৎপাদন করতেন তারা। যত ধরনের সুগন্ধি মশলা রয়েছে সবই তারা উৎপাদন করতেন। শিল্পে তারা মেধাকে এত বিকশিত করেছিলেন যে মসলিনের মতো সূক্ষ্ম কাপড় উৎপাদন করতেন তারা। টেক্সটাইল টেকনলজির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন এই মসলিন। আজ পর্যন্ত তুলো থেকে এর চেয়ে মিহি কাপড় তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আমাদের সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতেন। চট্টগ্রামে জাহাজ তৈরী হত। চট্টগ্রামে যেবহদ্দার হাটরয়েছে সেটি ছিলবহরদারঅর্থাৎ নৌবহরের দার বা প্রধানের জায়গা। আমাদের সওদাগররা জাহাজ বানাতেন। সেই জাহাজে তারা জাভা, সু্মাত্রা, মালদ্বীপ, সিংহল প্রভৃতি স্থানে যেতেন। বালিতে এখনও হনুমানের মূর্তি রয়েছে, রামায়নের নাটক অভিনয় তাদের সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে, কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা এই বাংলা থেকে গিয়েছিলেন। বাংলার বিজয় সিংহ সিংহলের পত্তন করেন, তার নামানুসারেই সিংহলের নাম। মধ্যযুগে ভাইকিংদের সাথে নৌযুদ্ধে এই বাংলা থেকে জাহাজ গিয়েছিল। সমুদ্রযাত্রা আমাদের সংস্কৃতির এতো অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল যে চাঁদ সওদাগর সিন্দাবাদের কাহিনীর মতো লোকসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল

ফলশ্রতিতে সেসময় আমাদের এই উপমহাদেশের জিডিপি ছিলো বিশ্বের জিডিপি- ২২-২৩% মুর্শিদাবাদ ছিলো লন্ডনের চেয়েও বড় শহর। লাহোরের অধিবাসীর সংখ্যা ছিলো ২০ লক্ষ। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে আমাদের পেশা সংক্রান্ত ধ্যানধারণা পরিবর্তিত  হতে শুরু করল। আমাদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হলো যে, আমাদের বৃদ্ধিবৃত্তিক এবং মানসিক কাজগুলো করার কোনো ক্ষমতাই আমাদের নাই।  আমাদের অবস্থা  দাঁড়াল শেকলে আবদ্ধ পাখির মত। এন্ট্রিপ্রিনিউরাল স্পিরিট (entrepreneurial spirit)  হারিয়ে আমরা নিজেদেরকে শুধুমাত্র চাকুরীজীবি অর্থাৎ চাকর ভাবতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করতে শুরু করলাম।  যেখানে আমাদের সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতো সেখানে সৃষ্টি হল কালাপানি ধারণা অর্থাৎ সমুদ্র যাত্রা যদি কেউ করে তো তার জাত চলে যাবে, জাতচ্যুত হবে ফলে কালক্রমে আমরা পরিচিত হলাম দুর্ভিক্ষপীড়িত, বন্যা জর্জরিত, জরাব্যাধি কবলিত একটি জনপদ হিসেবে

৯০ দশকে গার্মেন্টসে যারা বিনিয়োগ করলো তাদের সবাই দর্জি বলে ক্ষেপাতো! আবার অনেক মার্কেটের মালিককে নাকি লোকেদোকানদারবলে! কিন্তু তাতে কী এসে যায়? আপনার সম্মান, সামাজিক অবস্থান কিন্তু আপনার কাছে। আপনার মনে হচ্ছে অমুক কোম্পানির কর্মকর্তাকে লোকেবস-বসকরে, তার একটা ভারিক্কী পদবী আছে- অতএব সেরকম হওয়াটাই বোধহয় সম্মানের। কিন্তু এটা আসলে দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা ছাড়া কিছুই না। আর  এটিও হলো  ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থারই প্রভাব। ইংরেজরা যখন শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু করে, তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো একটা মধ্যম শ্রেণী তৈরি করা যারা শাসনে সহায়তা করবে। ইংরেজদের তুলনায় এদেরকে পয়সা কম দিতে হবে, কিন্তু এরা চিন্তা-চেতনায় ইংরেজদের দাস হিসেবে কাজ করবে। তখনকার দিনে এন্ট্রান্স পাশ করে ডেপুটি কালেক্টর বা সাব রেজিস্ট্রার অফিসে কেরানির চাকরি বা জজ কোর্টে পেশকারের চাকরি  আশেপাশের লোকদের কাছে খুব সম্মানীয় ছিলো। আর গ্রাজুয়েশন নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার বা উকিল বা মোক্তার হতে পারলে সেটা ছিল বিশাল ব্যাপার। তখন এপ্লিকেশনও লেখা হতো এভাবে যেইউর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট বা সাবজেক্টঅর্থাৎআপনার অত্যন্ত বাধ্যগত প্রজা

আমাদের মূল সমস্যা হলো আমরা কিন্তু চেতনা নিয়েই বড় হয়ে উঠেছি। আমরা এখনও চাকর হওয়াটাকেই একমাত্র সম্মানীয় বিষয় মনে করি। আমরা চাই কেউ বলবে, তখন আমি তার কাজ করে দেবো এবং যতটুকু বলবে ততটুকু করবো। আমরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে করতে চাই না। আর এই মানসিকতার কারণে আমরা জাতিগতভাবে পিছিয়ে পড়েছি। আসলে একজন মানুষ তার মেধা আগ্রহের ভিত্তিতে এবং সেবার মনোভাব নিয়ে চাকরি বা স্বাধীন পেশা যেকোনটি বেছে নিতে পারেন, এটি দোষের কিছু নয়। কিন্ত একথা সত্যি যে স্বাধীন পেশায় যেহেতু সবদিক নিজেকে খেয়াল রাখতে হয় তাই মেধা শতধারায় বিকশিত হবার সুযোগ পায়, বিশেষতঃ নেতৃত্ব বা ব্যবস্থাপকীয় গুণাবলি গড়ে ওঠে, চাকরিতে যা সম্ভব নয়

আসলে অসৎভাবে টাকা উপার্জনের যেমন অনেক ব্যবসা আছে, তেমনি হালাল রুজি কামানোরও অনেক পথ আছে। কাজেই যেখানে সৎভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে এবং অন্যের উপকার করার সুযোগ রয়েছে এরকম যেকোনো ব্যবসা বা চাকরি আপনি করতে পারেন। আমাদের চিন্তা করতে হবে যে আমি কোন কাজটা ভালো পারি, আমি কোন কাজে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। আমি কোন কাজে নিজের দক্ষতাকে, নিজের মেধাকে সেবায় রূপান্তরিত করতে পারি। সেটা বের করতে হবে এবং সেটাতে এক নম্বরে পৌঁছতে হবে। যদি জুতা সেলাই ভালো পারি, আমার জুতা সেলাই দেখে যেন সবাই বলেএমনভাবে সেলাই করা হয়েছে যে এটা সেলাই না অরিজিন্যাল বোঝাই যাচ্ছে না।অ্যাকাউনট্যান্ট  হলে সেরা অ্যাকাউনট্যান্টআইটি স্পেশালিস্ট হলে সেরা আইটি স্পেশালিস্ট , শিক্ষক হলে সেরা শিক্ষক , ইঞ্জিনিয়ার হলে সেরা ইঞ্জিনিয়ার  হতে হবে। যদি রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করি, সেরা ঝাড়ুদার হতে হবে রাস্তার কোন দাগ কীভাবে তুলতে হবে জানতে হবে আমি ঝাড়ু দেয়ার পর যাতে কোনো ময়লা না থাকে

আমাদের ক্যারিয়ার সংক্রান্ত হতাশা স্থবিরতার মূলে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত অবক্ষয়। যত আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই সাহসী চেতনাকে, সেই entrepreneurial spirit কে জাগ্রত করতে পারব, ততো আমাদের মেধাকে আবারো শতধারায় বিকশিত করতে পারব। নিজের অনন্য মেধাকে সেবায় রূপান্তরের মাধ্যমে নিজেই গড়তে পারব পরিতৃপ্তিময় কর্মজীবন